‘হাত পেতে চাইতে লজ্জা করে’
খুলনা বাঘের হাট রামপাল উপজেলার গৌরমবা গ্রামের মৃত লতিফ গাজির ছেলে মো. মোসারফ গাজী (৫৫)। অসহায় এই মানুষটির জীবনের গল্প শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।

০৩ নভেম্বর ২০১৫ মঙ্গলবার রাত ১১টা সংবাদের খোজে ছুটতে গিয়ে রাজবাড়ী শহরের রেল-ষ্টেশন লতিফ হোটেল রাতের খাবার খেয়ে বিল দেওয়ার সময় একজন মানুষ চোখে পড়লো । ক্রাচ হাতে দাঁড়ানো সাদামাটা টাইপের একজন মানুষ (পোষাকে দারীদ্রতার ছাপ থাকলেও মনে হল মানুষটি একসময়ে সচ্ছল ছিলেন ) পোশাকের মতই মলিন ভাঙ্গাচোরা একটি ফোন এগিয়ে ধরে বিনয়ের সুরে হোটেল মালিককে বলছে, ‘ভাই আমার এই ফোনটা একটু রাখবেন সকালে নিতাম’ । কেন জানি তাকালাম মানুষটির দিকে, সাংবাদিকতাই বলেন আর স্বভাবসুলভ কৌতুহলেই বলেন , জানতে ইচ্ছে হলো মানুষটার কথা ।


বেশ স্পষ্ট কথা বলা মানুষটি নিজের পরিচয়ে তার নাম জানালো ‘মোসারফ গাজী’ । বললো , ‘ বাবা আমি ঐ বট গাছের নিচে রাতটা কাটাবো, যদি ঘুমিয়ে যাই আর রাতে যদি কেউ চুরি করে নিয়ে যায় সেজন্য হোটেলে রাখতে চাই ফোনটা ।

আমার মনে হয় প্রতিটি মানুষের জীবনই এক একটা গল্প, এক একটা উপন্যাস। এসব গল্পে আছে নানা উত্থান পতন, নানা টুইস্ট। হাতে তেমন একটা কাজ ছিলোনা , বাড়ি ফেরার তাগাদাও ছিলোনা , ভাবলাম একটু কথা বলে সময় পার করা যাক, ফাকে যদি জেনে নেয়া যায় আরও একটি জীবনের গল্প, সে লোভটাও ছিলো ।
সেই তাগিদেই আগ বাড়িয়ে কথা বাড়ালাম, চাচা সম্বোধন করেই বললাম , ‘কেন রেল ষ্টেশনেতো শুয়ে থাকতে পারেন, বিনয়ী উত্তরে মোশাররফ গাজী জানালেন , আমার কাছে আছে ২৫ টাকা আর ওখানে ঘুমাতে লাগে ২০ টাকা, তাই গাছের নিচে শুয়ে থাকাই ভালো, না হয় একটু ঠান্ডা লাগবে, কিন্তু টাকাটাতো বাঁচবে ।
এক পা ছাড়া ক্রাচ হাতে খুব কষ্টে হাটতে থাকা মানুষটিকে দেখে মায়া লাগছিলো শুরু থেকেই, ততক্ষনে দুজনে হাটতে হাটতে বটগাছের নিচে পৌছে গেছি । বললাম, চলেন আমি দিয়ে আসি , ওখানে থাকতে টাকা লাগবেনা আপনার।

ততক্ষনে কাধের ব্যাগটি মাটিতে রেখে একটু হাফ ছেড়ে বসে পড়েছেন উনি, এতটুকু বলাতেই কস্ট ভরা মুখে কৃতজ্ঞতার হাসিতে সেই বিনয়ের সঙ্গেই তিনি জানালেন, ‘ বাবা আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, আমি বেশ থাকতে পারবো এখানে, পাশে দাড়িয়ে কথা বলতে বলতেই উনি ব্যাগ থেকে পলিথিন বের করে বিছানা করে ফেললেন ।
এরপর আমার আগ্রহ দেখেই হয়তো, উনার পাশে বসার জন্য ইশারা করতেই আমি বসে পড়লাম উনার পাশে। জিজ্ঞেস করলাম আপনার ছেলে মেয়ে নাই…? বড় একটি নিশ্বাস নিয়ে বললেন, একটি মেয়ে ছিলো বিয়ে দিয়েছি কিছুদিন আগেই ।
এখন আমি আর আমার স্ত্রী সহ আমাদের সংসার । জানতে চাইলাম ; আচ্ছা আপনি কি করেন, আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হঠাত চোখ ছলছল হয়ে গেলো তার , বুকে একটা যন্ত্রনা চেপে এবারই প্রথম স্পষ্ট করে বলতে পারলেননা তিনি, অভিমান মিশ্রিত অস্ফুস্ট স্বরে কিছুটা বললেন , ‘বাঁচার জন্য মানুষের কাছে চেয়ে খাই’ এই বলেই চোখ নামিয়ে ফেললেন তিনি। কিছুক্ষন সুনসান নীরবতা এবার অসহায় চোখে কাতর গলায় বলে উঠলেন , ..কিন্তু… বাবা এভাবে মানুষের কাছে চাইতে ভীষণ লজ্জা করে’।

জানিনা কি ছিলো উনার কথায়, এক মুহূর্তে আমার ভেতরেও কোথায় যেন খুব ছুয়ে গেলো । একটু বিষণ্ণ হয়েই, আপত্তি না থাকলে উনার জীবনের গল্প জানতে চাইলাম । আমি সাংবাদিকতা করি ততক্ষনে বলেছি উনাকে।

এবার বলতে শুরু করলেন মোশাররফ গাজী , মোবাইলের কিপ্যাড চেপে সময়টা দেখলাম ; রাত ১১ টা ২০ মিনিট, আমি মুগ্ধ অথবা বিমূর্ত শ্রোতা তখন।

‘খুলনা বাগের হাটে আমার নিজের ফার্নিচারের দোকান ছিলো, নকশা কাটার মেশিন, জানাকয়েক কর্মচারী । কয়েক লক্ষ টাকাও জমানো ছিলো ব্যাংকে , নিজেও বেশ ভালো কাজ জানতাম। সংসারে সচ্ছলতা, সুখ সবই ছিলো। গ্রামের দিকে কিছু জমি থেকেও টাকা আসতো । বেশ ভালোই কাটছিলো। হঠাত ২০০১ সালের শেষের দিকে গেংড়ি নামক এক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ি আমি। আমার এই পাটাকে বাঁচানোর জন্য ভারতে গিয়েছিলাম ৮ বার, দেশেও অনেক চিকিৎসা করিয়েছি । নিজের যা কিছু ছিলো সব কিছু বিক্রি করেও পা টাকে রাখতে পারিনি। (ততক্ষনে দুচোখ বেয়ে পানি ঝড়ছিলো মোশাররফ গাজীর )। একসময় ঐ রোগের কারনে পচনের কাছে হার মেনে কেটে ফেলতে হয় পা টা । সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি ছিলাম আমি। এরপর আস্তে আস্তে সংসারে অভাব বাড়তে থাকে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিজের দোকানটাও ততদিনে হারিয়েছি। সংসারের দায় আর বেঁচে থাকার তাগিদে খুব কষ্ট করে হলেও টুকটাক করে কাঠ মিস্ত্রীর কাজ করতাম বিভিন্ন জায়গায়। এভাবেই বেশ কয়েকবছর। কিন্তু এখন শরীরে অসুস্থতার কারনে সেটাও পারিনা । অল্প যেটুকু ছিলো সেটা বেঁচে ধার দেনা করে একমাত্র মেয়েটার বিয়ে দিয়েছি । বর্তমানে আমার স্ত্রীও অসুস্থ্য। তার পরেও সে বাড়ির সামনে একটা ছোট চায়ের দোকান করতো সেটাতেও কোন বেচা বিক্রি হয় না । দোকান চালানোর সেই পুজিও হারিয়েছি ‘।

এবার একটু থেমে স্মৃতি হাতড়ে বলতে শুরু করলেন আবার,
‘যখন ভালো ছিলাম আমিই মানুষকে এই হাত দিয়ে অনেক সাহায্য দিয়েছি অথচ আজ সেই হাত দিয়েই আমাকে মানুষের কাছে চেয়ে খেতে হচ্ছে ! আমার মত আর কারো জীবনে যেন এমন সময় না আসে। সব কিছু শেষ আমার চিকিৎসার জন্য, আজ আমি পথে পথে ভিক্ষা করছি এটা আমার কপাল। (এবার ডুকরে কাঁদতে শুরু করলেন মোশাররফ গাজী)।
ভেজা গলায় জানালেন, এখন আমি আর আমার স্ত্রী সম্পূর্ণ নিঃস্ব। কোথাও থেকে এক টাকাও উপার্জনের পথ নেই আর । এখন চিন্তায় আছি যে কয়েকটি সমিতি ও সোনালী ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিলাম সেগুলো কিভাবে শোধ করবো।নিজের এলাকার জনপ্রতিনিধিদের কাছে পঙ্গু ভাতার জন্য অনেক ঘুরেও সাহায্য পাইনি। এভাবে ঘুরে ফিরে আমি যা পাই আমার আর আমার স্ত্রীর খাওয়ার টাকাও হয়না ।

এরপর বললেন,আমি অসুস্থ্য হবার পর আমার স্ত্রী বাড়ির সামনে একটা ছোট চা দোকান শুরু করছিলো, আমি সাহায্য করতাম, পরিশ্রমের ক্ষমতা ছিলোনা । কিন্তু মাসকয়েক আগে সেই চা দোকানটা বন্ধ হয়ে যাবার পর একদিকে স্ত্রীর অসুস্থতা অন্যদিকে পেটের ক্ষুধায় বাধ্য হয়ে কোন কুল-কিনারা না পেয়ে মাত্র কদিন আগে থেকেই মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে শুরু করেছেন তিনি।

এবার অনেকটা উদাস হয়ে বললেন , ‘নিজের এলাকায় একসময় সচ্ছল হিসেবে পরিচিত ছিলাম আমি, অনেক মানুষ আমাকে চিনতো, মেয়ের বিয়েও দিয়েছি পাশের এলাকায়। কোনদিন একবারের জন্য কল্পনাতেও আসেনি এমন দিন আসবে আমার। তাই ওখানে কারো কাছে হাত পেতে সাহায্য চাইতে লজ্জা লাগে। বাধ্য হয়ে আজক ট্রেনে করে রাজবাড়ী আসলাম, ট্রেনের মধ্যে এই কামরা সেই কামরা ঘুরে ৫০টাকার মত পেয়েছি । গল্পের ফাঁকেই জানালেন উনি মানুষের কাছে এভাবে সাহায্য চেয়ে নিচ্ছেন সেকথা উনার স্ত্রী অথবা মেয়ে কেউ জানেনা। জানলে অনেক কষ্ট পাবে তারা সেকথাও বললেন।

চুপ করেই শুনছিলাম এতক্ষন , কিন্তু এবার উদ্বিগ্ন কন্ঠে ‘এত কম’! জিজ্ঞেস করতেই চোখের পানি ফেলে দিয়ে তিনি জানালেন, আসলে বাবা, আমিতো কোন দিন এ ধরনের কাজ করিনি..মানুষের কাছে হাত পেতে চাইতে পারি না। অনেক চেষ্টা করেছি তবুও গলা দিয়ে কিছু বের হয়না , এই অবস্থায় যে আমাকে দেখে কিছু দিয়েছে তাই নিয়েছি। ৫০ টাকার মধ্যে ২৫টাকা দিয়ে ডাল ভাজি দিয়ে ভাত খেলাম । বাবা আমার জীবনে এমন সময় আসবে আমি ভাবতেও পারিনি..তার পরেও আল্লাহ আমাকে বাচিয়ে রেখেছে সে জন্য আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া।

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, ভাবছিলাম মানুষের জীবনে কত প্রতিবন্ধকতা, কত কষ্ট , সে তুলনায় আল্লাহ অনেক ভালো রেখেছে আমাদের। এই মানুষটা তার এমন অসহায়ত্বের মধ্যেও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছে ! অথচ অনেক ভালো থেকেও আমরা অনেকেই সেটা করিনা ——

মোবাইলের আলো জালিয়ে দেখলাম, গল্পে গল্পে রাত তখন সাড়ে বারোটা, বাসায় ফেরার তাগিদ থেকেই উনাকে বিদায় জানিয়ে উঠলাম। কিছুদুর এসেই কি ভেবে আবার ঘুরে গিয়ে পকেট থেকে খুচরো কয়েকটা টাকা মুঠো করে উনার দিকে বাড়িয়ে দিলাম (আমার সাধ্য ছিলোনা অনেক দেয়ার, ৩০/৪০ টাকা হবে হয়তো ) । উনি নিতেই চাচ্ছিলেননা, বললেন, না বাবা আপনি এই দুখি মানুষটার গল্প এত মনযোগ দিয়ে শুনেছেন এটাই আমার জন্য অনেক পাওয়া । টাকা লাগবেনা, আমার জন্য দোয়া করবেন। আবার উনার বিনয়বোধ দেখে হতচকিত হলাম । শেষ অবধি উনাকে দিতে পারলামনা আর টাকাগুলো। আমি ফিরে এলাম, আসার সময় হোটেলের ক্যাশে দিয়ে আসলাম টাকাটা, ম্যানেজারকে বললাম সকালে উনাকে ডেকে কিছু খাইয়ে দিতে ।
সংগ্রহঃbanginews